শহীদ মিনারের স্থপতি?
- হামিদুর রহমান
- মঈনুল আহসান
- নিতুন কুন্ডু
- কামরুল হাসান
প্রশ্ন: #কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার কোথায় অবস্থিত?
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার — ভাষা আন্দোলনের অমর স্মৃতিচিহ্ন
বাংলা ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গকারী শহীদদের স্মরণে নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বাংলাদেশের গৌরব ও আত্মত্যাগের প্রতীক। এটি ঢাকার কেন্দ্রস্থলে, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বহিঃপ্রাঙ্গণে অবস্থিত। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি— আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে— হাজার হাজার মানুষ এখানে সমবেত হয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ভাষা শহীদদের প্রতি জাতির এই ভালোবাসাই আজ শহীদ মিনারকে ঢাকার অন্যতম ঐতিহাসিক ও পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত করেছে।
🏗️ প্রথম শহীদ মিনারের ইতিহাস
১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা নিজেদের উদ্যোগে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারির বিকেলে তারা কাজ শুরু করে রাতের মধ্যেই স্মৃতিস্তম্ভটি সম্পন্ন করেন। নকশা করেন বদরুল আলম, তদারকিতে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার শরফুদ্দিন, সহযোগিতা করেছিলেন সাঈদ হায়দারসহ আরও অনেকে।
মাত্র ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া এই মিনারটি মেডিকেল হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের পাশে তৈরি করা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ শফিউরের পিতা প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে মিনারটি উদ্বোধন করেন। পরদিনই, ২৬ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তানি পুলিশ ও সেনারা মেডিক্যাল হোস্টেল ঘিরে শহীদ মিনারটি ধ্বংস করে দেয়। এরপর ঢাকা কলেজেও আরেকটি শহীদ মিনার নির্মিত হলেও সেটিও সরকারি নির্দেশে ভেঙে ফেলা হয়।
🔰 দ্বিতীয় শহীদ মিনার ও পুনর্নির্মাণ
১৯৫৪ সালে একই স্থানে দ্বিতীয়বারের মতো একটি নতুন শহীদ মিনার নির্মিত হয়, যার উদ্বোধন করেন নাট্যগুরু নুরুল মোমেন। বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ১৯৫৭ সালে শুরু হয় নতুন কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ।
এর নকশা তৈরি করেন খ্যাতিমান ভাস্কর হামিদুর রহমান, আর সহায়তা করেন নভেরা আহমেদ। তবে ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির পর কাজটি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল আযম খান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাহমুদ হোসেনের তত্ত্বাবধানে পুনরায় নির্মাণ কাজ শুরু হয়।
মূল নকশার কিছু অংশ— যেমন ফোয়ারা ও নভেরার ম্যুরাল— বাদ দিয়ে দ্রুত কাজ শেষ করা হয়। অবশেষে ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, শহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম নতুন মিনারটির উদ্বোধন করেন।
🪨 ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন
১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে পূর্ত মন্ত্রী আবদুস সালাম খান শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের উদ্যোগ নেন। তবে সাধারণ জনগণের দাবিতে, ভাষা শহীদ রিক্সাচালক আওয়ালের মাত্র ছয় বছর বয়সী কন্যা বসিরণকেই এই স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের সম্মান দেওয়া হয় — যা আজও ইতিহাসের এক অনন্য ঘটনা।
🎨 স্থাপত্য ও নকশার বৈশিষ্ট্য
ভাস্কর হামিদুর রহমান শহীদ মিনারের নকশায় মায়ের স্নেহময় আলিঙ্গন ও সন্তানের প্রতীকী ভালোবাসা ফুটিয়ে তুলেছিলেন। মধ্যস্থলে সুউচ্চ স্তম্ভটি মাতার প্রতীক, আর দুই পাশে চারটি ছোট স্তম্ভ সন্তানের প্রতীক হিসেবে স্থাপন করা হয়।
ভাস্কর নভেরা আহমেদ দুটি ম্যুরাল ও একটি ফোয়ারা স্থাপনের পরিকল্পনা করেছিলেন, যা দুঃখজনকভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। তবুও এই স্থাপত্যে নিহিত আছে জাতির বেদনা, গর্ব ও স্বাধীনতার অনুপ্রেরণা।
🕊️ পবিত্রতা ও বর্তমান অবস্থা
শহীদ মিনারের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ন্যস্ত। প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি এখানে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠান হয়। তবে বছরের অন্যান্য সময়ে শহীদ মিনার প্রায়ই অবহেলিত অবস্থায় থাকে, এবং এলাকাটির চারপাশে অনিয়ম ও দখলদারির অভিযোগও রয়েছে।
জাতির গর্বের এই স্মৃতিস্তম্ভকে পরিষ্কার, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ রাখা আমাদের প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব।
🌺 উপসংহার
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার শুধু একটি স্থাপনা নয় — এটি বাংলাভাষার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামের প্রতীক, একটি জাতির আত্মমর্যাদার প্রতিফলন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মাতৃভাষা ও সংস্কৃতির প্রতি নতুন করে প্রতিজ্ঞা করে —
“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?”

0 Comments